২৪খবরবিডি: 'পিরোজপুরের যুবক মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে শফিউল্লা শেখ অনেকদিন ধরে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। সেই স্বপ্নকে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করে প্রস্তাব দেন বাদশা। মোট ১৩ লাখ টাকার চুক্তিতে গত ৪ অক্টোবর ঢাকা থেকে দুবাই পাঠানো হয় শফিকুলকে।'
'সেখানে আরও ২০ বাংলাদেশির সঙ্গে একটি বাসায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে সিরিয়া হয়ে লিবিয়া বিমানবন্দরের পাশে একটি বাসায় বন্দি করা হয় মোট ৪২ জনকে। এরপর শুরু হয় অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। সেখানে চক্রের সদস্যদের নির্যাতনে ইউরোপে যেতে বিভোর বাংলাদেশিদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। নির্যাতনের কথা পরিবারকে জানিয়ে টাকা আদায় করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, কারো কাছ থেকে ১০, ১২ ও ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। ৪২ জনের মধ্যে নির্যাতনের শিকার শফিকুল বলেন, আমার মধ্যবিত্ত পরিবার। জিম্মির পর আরও পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। বড় ভাইকে জানানোর পর তিনি অনেক চেষ্টা করেও টাকা সংগ্রহে ব্যর্থ হন। তিনি তেজগাঁও ডিবি পুলিশকে জানানোর পর গত ২৭ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা হয়। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগ তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের দেশীয় দুই সদস্য বাদশা ও রাজিব মোল্লাকে গ্রেপ্তার করে।গ্রেপ্তারদের মাধ্যমে লিবিয়ায় অবস্থান করা সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য সুলতানের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্যাতনের শিকার সফিকুল ইসলামকে লিবিয়া থেকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় ডিবি। গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, না জেনে, না বুঝে ইউরোপে যেতে উদগ্রীব তরুণ যুবকদের টার্গেট করে ফাঁদ পাতে দেশে ও লিবিয়ায় অবস্থানকারী চক্রের সদস্যরা। তাদের মাধ্যমে অনেককে অবৈধভাবে দুবাই থেকে নৌ, সড়ক পথ পাড়ি দিয়ে লিবিয়ায় নেওয়া হয়েছে। অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।'
'মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান মোহাম্মদ হারুন-অর-রশিদ বলেন, ইউরোপে পাঠানোর নাম করে দুবাইয়ে নেওয়ার পর ডলার, পাসপোর্ট নিয়ে অবৈধ পথে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করা হচ্ছে বাংলাদেশিদের। সম্প্রতি সফিকুল নামে এক বাংলাদেশিকে ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি, নির্যাতন করা হয় টাকার দাবিতে। পরিবারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।
'ইউরোপে অনিশ্চিত যাত্রা, প্রলোভন-ফাঁদে স্বপ্নবাজ বাংলাদেশিদের'
ফিরিয়ে আনা হয় লিবিয়া থেকে অপহৃত সফিকুলকে। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও ডেমরা থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার চক্রের দুই সদস্য হলেন— বাদশা (৩১) এবং রাজিব মোল্লা (৩৫)। হারুন বলেন, আমরা গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে মানব পাচারকারী চক্রে জড়িত আরও অনেকের নাম জেনেছি। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সারা দেশে অনেক থানাতেই মানব পাচারের অভিযোগে মামলা হচ্ছে। অনেক তরুণ-যুবক ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত চুক্তিতে ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেতে অনিশ্চিত যাত্রা শুরু করে। তাদের অনেককে দুবাই নিয়েই জিম্মি করা হয়।'
'উদ্ধার ভিকটিম সফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার বাদশা তাকে ইতালি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে গত ৪ অক্টোবর ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে দুবাই পাঠায়। সেখানে রাজিবের আত্মীয় দুবাইয়ে অবস্থান করা সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের সদস্য সবুজ এয়ারপোর্টে ভিকটিমসহ আরও ২০ জনকে রিসিভ করে একটি বাসায় নিয়ে যায়।এরপর দুবাই থেকে সিরিয়া হয়ে লিবিয়ার মিসরাত এলাকার একটি ক্যাম্পে আটকে রাখে। সেখানে বাদশা ও রাজিবের বোন জামাই গাইবান্ধার সুলতানের নেতৃত্বে ভিকটিমকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। ভিকটিমকে নির্যাতন করে মোবাইল ফোনে তার পরিবারকে কান্না শুনিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। এক প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, গ্রেপ্তাররা আন্তঃদেশীয় সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের সদস্য। বাদশা ও রাজিব দেশের বেকার যুবক ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার লোকদের ইতালি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় পাচার করে। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেকে এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কেউ কেউ মারা গেছেন। কেউ এখনো টাকা দিতে না পারায় নির্যাতিত হচ্ছেন, বন্দি জীবনযাপন করছেন। আরেক প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, দেশের বাইরে যারা মানব পাচারে জড়িত তাদের গ্রেপ্তার সম্ভব নয়। যেহেতু মামলা হয়েছে, আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেব'।
'পাশাপাশি দেশ থেকে যদি কেউ বৈধভাবে ইউরোপ পাঠানোর স্বপ্ন দেখাতে না পারে সেজন্য দেশে অবস্থান করা মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। ডিএমপির এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, প্রলোভন ও চক্রের খপ্পরে পড়ে তরুণরা জিম্মি হচ্ছে লিবিয়ায়, পরিবারগুলো নিঃস্ব হচ্ছে। তাই যথাযথ প্রক্রিয়ায় বৈধভাবে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইউরোপে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।লিবিয়া থেকে উদ্ধারের পর দেশে ফেরা ভুক্তভোগী সফিকুল বলেন, দুবাই যাওয়ার পরই বুঝতে পারি একা নই, আরও অনেক বাংলাদেশিকে তারা এখানে আনার পর জিম্মি করেছে। লিবিয়ায় নেওয়ার পর ভয়ানক নির্যাতন নেমে আসে। অথচ দেশে থাকতেই সাত লাখ টাকা দিয়েছিলাম। কথা ছিল ইতালিতে চাকরি হওয়ার পর বাকি পাঁচ লাখ টাকা নেবে। কিন্তু তারা ইতালি তো দূরের কথা লিবিয়ায় নিয়ে বন্দি করে, নির্যাতন করে টাকা আদায় করে।'